স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন অনেকেই। কেননা একটা সময় ছিল যখন শুধুমাত্র শোনা যেত– স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে। সেই সময়ে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিচ্ছে এমন ঘটনা ঘটেনি বললেই বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও চাইলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
তবে হ্যাঁ এটা ঠিক, তালাকের ক্ষেত্রে মূলত মুসলিম আইন অনুযায়ী স্বামীর ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থেকে থাকে একজন স্ত্রীর তুলনায়। কেননা স্বাভাবিকভাবেই একজন স্বামী চাইলেই কোন রকম কারণ না দেখিয়ে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। অথচ একজন মেয়ের ক্ষেত্রে অর্থাৎ স্ত্রী হিসেবে তালাকের বিষয়টি অনেকটাই ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এজন্যই মূলত জানতে চান– একজন মুসলিম স্ত্রী কি তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে? একজন মেয়ে হয়ে স্বামীকে তালাক অর্থাৎ স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি কি? একজন স্ত্রী ঠিক কখন তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে?
আরও পড়ুনঃ মার্কেটিং অফিসারের কাজ কি | মার্কেটিং অফিসারের যোগ্যতা, বেতন ও পদোন্নতি
মূলত এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা আমাদের আজকের আর্টিকেলে। তাই আপনারা যারা স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তারা অবশ্যই আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ুন। কেননা আজ আমরা, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তালাক দেওয়ার নিয়ম, আদালতের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম, খোলা তালাক দেওয়ার নিয়ম, মুখে তালাক দেওয়ার নিয়মসহ এ টু জেড আলোচনা করব।
স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম
একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে যে যে নিয়ম অনুসরণ করবে ঠিক একইভাবে একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রেও ওই একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। মূলত স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দিয়ে থাকুক না কেন, সেক্ষেত্রে দেনমোহরের অর্থ অবশ্যই স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে– যেটা কাবিল নামায় উল্লেখ করা থাকে।
আপনি যদি একজন মেয়ে হিসেবে জানতে চান, যে স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ায় নিয়ম কি? তাহলে বলবো এর পূর্বে আপনার আরো কিছু বিষয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরী। কেননা স্বামী বা স্ত্রী যে তালাক দিয়ে থাকুক না কেন নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বা আইন মেনে চলতে হবে এবং কারণ হিসেবে কিছু চিহ্নিত অবশ্যই করতে হবে। যা আমরা আর্টিকেলের এ পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরবো। তাই সুস্পষ্ট ধারণা পেতে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে নিচের পয়েন্ট গুলো পড়ুন।
ডিভোর্স কাকে বলে?
ডিভোর্সকে আমরা মূলত শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বিবাহ-বিচ্ছেদ অথবা তালাক বলে থাকি। বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। যেটা একজন নারী এবং পুরুষকে একসাথে সারা জীবন থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ করে।। কিন্তু বিভিন্ন কারণে মূলত সেই বিবাহর বন্ধন ভেঙে যায় আর সেটার মাধ্যমে এই ডিভোর্স তালাক বলে সম্বোধন করা হয়।
আমাদের সমাজে আশেপাশে তাকালে বর্তমানে এমন অনেক স্বামী-স্ত্রী দেখা যায় যারা ইতোমধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে আবার অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাবে অর্থাৎ তালাক দেবে একে অপরকে ছেড়ে দেবে। অনেকেই জানেন না তালাকের প্রকারভেদ কি? মূলত আইন অনুযায়ী তালাক ৩ প্রকার। যথা:-
- স্বামী কর্তৃক তালাক
- স্ত্রি কর্তৃক তালাক
- পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক
- আদালত কর্তৃক তালাক
স্ত্রী কর্তৃক তালাকের নিয়ম কি?
স্ত্রী কিভাবে তার স্বামীকে তালাক দিবে? তালাক দেওয়ার জন্য কোথায় যেতে হবে এবং কি কি করতে হবে? এর জন্য বাংলাদেশে ডিভোর্সের আইন কি? সে সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরী। তাই আসন আলোচনার এ পর্যায়ে জেনে নেই স্বামীকে তালাক দিতে হলে বাংলাদেশের আইনে কি কি বিষয় মাথায় রাখতে হবে এবং কি কি নিয়ম মেনে চলতে হবে!
আরও পড়ুনঃ বায়িং হাউজে চাকরি পাওয়ার উপায়
বাংলাদেশের আইনে তালাক বা ডিভোর্সের নিয়ম
বাংলাদেশে পূর্বের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী– তালাক দিতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে তিনটি দফায় আইনের পত্র অর্থাৎ ডিভোর্স লেটার পাঠাতে হবে। প্রতি ৩০ দিনের ব্যবধানে এক একটি চিঠি পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। মূলত এই ৯০ দিনের মধ্যে যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা না হয় তাহলেই তালাক কার্যকর করা হবে, নয়তো না।
আর এই তিনটি দফা স্বামী এবং স্ত্রী যে চিঠিগুলো পাঠাবে এবং পরবর্তীতে সেই সমঝোতার উপর ভিত্তি করে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অথবা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অথবা কাউন্সিলর কে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশের কপি পাঠাতে হবে। পরবর্তীতে কাজী নির্ধারিত ফ্রি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করে ফ্রি ব্যতীত প্রত্যয়ন কপি প্রদান করতে হবে।
আর হ্যাঁ, বাংলাদেশের আইনে একজন স্ত্রী স্বামীকে যে সকল কারণে তালাক দিতে পারবেন সেগুলো হলো:-
- চার বছর যাবত স্বামী নিরুদ্দেশ হলে
- স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি কারাদণ্ড হলে
- দীর্ঘ দুই বছর একজন স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে
- কোন কারণ ব্যতীত দীর্ঘ তিন বছর শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছায় স্বামী কোন দাম্পত্য দায়িত্ব পালন না করলে
- বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে
- বিবাহ অস্বীকার করলে
- দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা কোন গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে
- একের অধিক স্ত্রী মতের বিরুদ্ধে গ্রহণ করলে
- স্বামী অতিরিক্ত অমানবিক বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে।
তাই, যে সকল স্ত্রীরা জানতে চান যে একজন স্বামীকে ঠিক কখন তালাক দেওয়া যায়? তাদেরকে বলব এই কারণগুলো মিলিয়ে নিন। কেননা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই কারণগুলোকে সামনে রেখে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে।
মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী যে সকল কারণে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন সেগুলো জানতে নিচের ইমেজটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন
ডিভোর্স দিতে কত টাকা লাগে
স্বামীকে ডিভোর্স দিতে কতদিন সময় লাগে? এটা খুবই কমন একটা প্রশ্ন। আপনারা যদি এতক্ষণ পর্যন্ত আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে ইতিমধ্যে এই প্রশ্নের উত্তরটি পেয়ে যাবেন। কেননা আমরা তিনটি দফায় ডিভোর্স কার্যটি সম্পন্ন করা হয় এটা উল্লেখ করেছি। আর ওই তিনটি দফা সম্পন্ন হতে ৯০ দিন সময় লাগে। তাই বলা যায় ডিভোর্স দিতে মূলত আপনাকে ৯০ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম ২০২৩
২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে স্ত্রী তার স্বামীকে তিন ভাবে তালাক দিতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে-কাবিননামার ১৮ নাম্বার কালাম।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে- খুলাতালাক এবং তৃতীয়টি হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে তালাক।
প্রথম পদ্ধতিতে তালাক দিতে চাইলে যা যা করতে হবে:-
এই পদ্ধতিতে যারা তালাকের কার্যটি সম্পন্ন করতে চাইবে তাদের মূলত এলাকার চেয়ারম্যানের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা চেয়ারম্যান বা মেয়র তালাকের নোটিশ পাওয়ার পরবর্তীতে ৩০ দিনের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা হয়েছে কিনা সেটা কনফার্ম করলে পরবর্তীতে সালিশি পরিষদের প্রধান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একনিষ্ঠ হয়ে তাদের তালাকের কার্যকারিতা সমাপ্ত করবেন।
আরও পড়ুনঃ কেন করবেন ডিজিটাল মার্কেটিং?
তবে হ্যাঁ যদি সালিশি পরিষদ সমঝোতা করাতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রীর নোটিশ প্রথম চেয়ারম্যান যেদিন গ্রহণ করেছিল সেদিন থেকে শুরু করে ঠিক ৯০ দিনের পর তালাক কার্যকর হবে। আর হ্যাঁ অনেকেই জানেন না যে নোটিশ কিভাবে পাঠাতে হয়? এই নোটিশ মূলত আপনি নিজের হাতে লিখেও পাঠাতে পারেন আবার কাজের মাধ্যমে লিখে পাঠাতে পারবেন। কেননা কাজী অফিসে কিছু ফরমেট রাখা হয় যেগুলো আপনি তাদের কাছ থেকে কিনে সেই ফরমেটে আপনার নাম ঠিকানা বসিয়ে তালাকের কারণ উল্লেখ করে ওই তালাকের নোটিশটি নির্দিষ্ট স্থানে পাঠাতে সক্ষম হবেন।
শুধু তাই নয় আপনি চাইলে ভালো কোন আইনজীবির মাধ্যমেও তালাকের নোটিশ পাঠাতে পারবেন। তবে তালাকের ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্যি এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করতে হবে। তাই অবশ্যই তালাক দেওয়ার পূর্বে এই নিয়মগুলো ও পদ্ধতি গুলো নিয়ে এনালাইসিস করার চেষ্টা করবেন এবং ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবেন। কেননা বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন আর এই বন্ধন ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত মধুর এবং অতি সুন্দর। যা আমাদের জীবনকে বরকতময় করে দিতে সক্ষম।
যদি দ্বিতীয় পদ্ধতিতে তালাক দিতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকে খোলাতালাকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। খোলা তালাক মূলত সমঝোতার মাধ্যমে করা হয়। দেনমোহর স্ত্রীকে প্রদান করতে হয় না। সুতরাং যদি তাদের মধ্যে বোঝাপড়া না থাকে এবং তারা দুজনেই তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে স্ত্রী এবং স্বামীর দুজন একে অপরকে তালাক দেবে কোনরকম দাবিনামা না রেখে। অন্যদিকে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিলে অবশ্যই মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন 1939 অনুসারে কারণগুলো চিহ্নিত করা হবে, যেটা আমরা ইতোমধ্যে উপরে ইমেজ আকারে উল্লেখ করেছি। এবার আসুন জেনে নেই স্ত্রী তালাক ছেলে করনীয় কি এবং একজন পুরুষকে যদি তালাক দেওয়া হয় তাহলে কি ক্ষতি হতে পারে?
স্ত্রী তালাক চাইলে করণীয় কি?
কোন স্ত্রী যদি সংসার করতে না চায় তবে তাকে জোর করে সংসার করানো কিংবা বাধ্য করা বা সংসার করাতে জোর করা যুক্তি সঙ্গত নয়। কেননা দিয়ে একটি নারী এবং পুরুষের মধ্যে স্বর্গের সম্পর্কের বন্ধন। আর তাই যখন এই সম্পর্কে টানা পূরণ চলে এবং বিষাদের ছায়া নেমে আসে তখন অবশ্যই শান্তি এবং নিজেদের মঙ্গলের জন্য হলেও বিচ্ছেদ হওয়াটা জরুরী।
তাই স্ত্রী তালাক চাইলে এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার করণীয় হবে তালাক দিয়ে দেওয়া। আর হ্যাঁ যারা বলেন স্ত্রী তালাক দিলে কি দেনমোহর পাবে? তাদের উত্তর হবে হ্যাঁ, স্ত্রী কে তালাক দিলেও তারা দেনমোহরের অধিকার রাখে। কেননা বাংলাদেশের ইসলামী আইনে একজন নারীকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে হলে অবশ্যই দেনমোহর দিতে হবে। এটার কোনই বিকল্প নেই। তবে যদি কোন স্ত্রী সদিচ্ছায় বলেন যে তিনি দেনমোহর গ্রহণ করতে রাজি নন তাহলে সেটা অন্য কথা।
তাই বলবো, যদি কোন স্ত্রী তালাক চেয়ে থাকেন তাহলে জটিলতা না বাড়িয়ে তালাক দিয়ে দেওয়া। কেননা তালাক দেওয়ার অধিকার স্বামী স্ত্রী উভয়ের রয়েছে। হ্যাঁ এটা ঠিক ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামীদের তালাক দেওয়ার অধিকার অনেকটা বেশি তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা নিষিদ্ধ নয়। তাই একজন মেয়ে ডিভোর্স চাইলে তাকে অবশ্যই ডিভোর্স দিতে হবে কেননা এটা তার অধিকার।
তালাক দিলে পুরুষের কি ক্ষতি হয়?
মেয়ে ডিভোর্স দিলে কি হয় ? তালাক দেওয়ার ফলে একজন পুরুষের কি কি ক্ষতি হয়? সত্যি বলতে এই প্রশ্নের উত্তর একেবারেই অযৌক্তিক। কেননা একজন মেয়ের যেমন তালাকের মাধ্যমে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় ঠিক একই রকম একটা পুরুষেরও হয়ে থাকে। কেননা এটা একটা সম্পর্ক, যেটা দুইটা মানুষকে এক করে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ পবিত্র বন্ধন, আর এই বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেলে ওই নারী এবং পুরুষ একেবারেই আলাদা। তাই তালাক দিলে একজন নারীর যেমন মানহানি ঘটে, মানসিক প্রেসার পরে, ব্যক্তিগত কিছু ক্ষতি হয়ে থাকে– ঠিক একই ভাবে একজন স্বামীরও ঠিক ওই একই ক্ষতি হয়ে থাকে।
পরিশেষে: তো ফ্রেন্ডস স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কিত আর্টিকেলের আলোচনা এ পর্যন্তই। যদি কোন মন্তব্য বা প্রশ্ন থেকে থাকে আমাদের কমেন্ট সেকশনে জানাবেন এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলের নোটিফিকেশন পেতে সাথে থাকবেন। সবাইকে আল্লাহ হাফেজ।