কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই সমুদ্রের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পানি প্রবাহিত হয়। পৃথিবীর মোট জল সরবরাহের দিক দিয়ে, প্রায় ৯৭ শতাংশ জল সমুদ্র গুলোই সরবরাহ করে থাকে। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন তো, পৃথিবীতে কতগুলো সমুদ্রের আনাগোনা রয়েছে! তবে মহাসাগর কয়টি ও কী কী এই প্রশ্ন নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদন্দে ভুগেন।
মহাসাগর কয়টি ও কী কী
পৃথিবী নামক এই নীল গ্রহের মানচিত্র টা বেশ ভালোভাবে মাপ যোগ করলে দেখা যাবে, পাঁচটা মহাসমুদ্র আর ৬৬ টা সমুদ্র মিলিয়ে পৃথিবীর ৭১ ভাগ অংশ জল, আর বাকিটা স্থল। মহাসমুদ্র মহাসাগর বা মহাসিন্ধু এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ওসেন(Ocean)। যার উৎপত্তি ঘটে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ওকিয়ানোজ থেকে। মহাসাগরগুলোর অর্ধেকেরও বেশি জায়গার গড় গভীরতা প্রায় ৯৮০০ ফুটেরও বেশি। লবণাক্ততার পরিমাণ ৩.৫ শতাংশ এবং প্রায় সকল সমুদ্রের গড় লবণাক্ততা ৩ শতাংশ থেকে ৩.৮ শতাংশ। পরীক্ষকরা পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে, প্রায় ২,৩০,০০০ সামুদ্রিক জলজ প্রাণী রয়েছে বিশাল এই মহা সমুদ্রের বুকে। প্রাশ্চাত্য ভূগোলবিদরা তাদের নিজেদের সুবিধার্থে পৃথিবীর মহাসমুদ্র গুলোকে পাঁচটি অংশে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে-
আরও পড়ুনঃ জেনে নিন পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অজানা তথ্য
- প্রশান্ত মহাসাগর
- আটলান্টিক মহাসাগর
- ভারত মহাসাগর
- দক্ষিণ মহাসাগর ও
- উত্তর মহাসাগর।
প্রশান্ত মহাসাগরঃ
প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর মহাসাগর সম্বন্ধনীয় বিভাগ গুলোর মধ্যে আয়তন ও গভীরতার বিচারে সবচেয়ে বড়। এর আয়তন পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের আয়তনের চেয়েও অধিক বেশি যা উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত। আর মূলত ভূমধ্য রেখা একে উত্তর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ভাগ করে রেখেছে। উত্তরে উত্তর মহাসাগর বা সুমেরু মহাসাগর থেকে দক্ষিণ মহাসাগর বা কুমেরু মহাসাগর। প্রক্ষান্তরে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত এই মহাসমুদ্রের বিস্তৃত। যার পশ্চিম সীমান্তে রয়েছে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্ব সীমান্তে রয়েছে উভয় আমেরিকা। এর আয়তন ১৬ কোটি ৯২ লাখ বর্গ কিলোমিটার। যা পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ৩২ ভাগ আর স্থলভাগের আয়তন এর প্রায় ৪৬ ভাগ। এর গভীরতা ১৪ হাজার ফুট। এর সবচেয়ে গভীরতম অংশের নাম মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। যা উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর গড় গভীরতা ৩৫ হাজার ৮০০ ফুট। বাকি চারটি মহাসাগরের সম্মিলিত দ্বীপ সংখ্যার চেয়েও অধিক বেশি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই মহাসাগরে রয়েছে ২৫ হাজার দ্বীপ আর প্রত্যেকটি দ্বীপগুলো মাইক্রোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়া নামের তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। মাইক্রোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ হলো তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির। এগুলোর মধ্যে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম। অপরদিকে মেলানেশিয়া দ্বীপগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপ নিউ গায়ানায় অবস্থিত। এছাড়াও এই অঞ্চলের মধ্যে ফিজি, ভানুয়াতু, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ উল্লেখযোগ্য। আর এর সর্ববৃহৎ অঞ্চল পলিনেশিয়া। যা ১৩০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আর এর প্রায় মাঝখানে থাকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম হচ্ছে টুভালু, সামোয়া, টোঙ্গা, পূর্ব দ্বীপপুঞ্জ এবং কুব দ্বীপপুঞ্জ।
আরও পড়ুনঃ ভাষার ইতিহাস | ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
আটলান্টিক মহাসাগরঃ
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর হলো আটলান্টিক মহাসাগর। এর আয়তন ১,০৬,৪৬০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের প্রায় পঞ্চমাংশ এলাকা জুড়ে বৃস্তিত মহাসাগরটির গড় গভীরতা ১০ হাজার ৯২৫ ফুট। পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্জ হলো এর সবচেয়ে গভীরতম এলাকা। আটলান্টিক মহাসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পশ্চিমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং পূর্বে ইউরোপ আফ্রিকা মহাদেশ অবস্থিত। আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব মহাসাগরের একটি অংশ হিসেবে এটি উত্তরে সুমেরু মহাসাগর, দক্ষিণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ পূর্বে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণে দক্ষিণ মহাসাগর এর সাথে সংযুক্ত। আটলান্টিকের উপকূলে বিভিন্ন প্রকারের অসংখ্য উপসাগর এবং সাগর রয়েছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাল্টিক সাগর, কৃষ্ণ সাগর, ক্যারিবীয় সাগর, ডেভিস প্রণালী, ডেনমার্ক প্রণালী, জলপথের অংশবিশেষ, মেক্সিকো উপসাগর, ভূমধ্যসাগর, উত্তর সাগরের প্রায় পুরোটা এবং অন্যান্য ছোটখাটো ভূমি। এর শীর্ষ বড় সমুদ্রের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম ও গভীরতম সাগর সারগাসো সাগর। যার আয়তন ৩.৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার আর ক্ষুদ্রতম সাগর দীপ মালা। যার আয়তন এর পরিমাণ ৮৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর সবচেয়ে উচ্চতম ভূমি মালভূমি এবং বারমুডা।
ভারত মহাসাগর
পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর হলো ভারত মহাসাগর। উত্তরে অবস্থিত ভারত মহাদেশের নাম অনুসারে এই মহাদেশের নামকরণ করা হয় ভারত মহাসাগর। যার উত্তরে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান। পশ্চিমে আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকা, পূর্বে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপ ও অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণে এন্টার্কটিকা দ্বারা আবদ্ধ। এর মোট আয়তন প্রায় ৭,৩৪,২৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার। পৃথিবীর মোট জলের ২০ শতাংশ এই মহাসাগরে রয়েছে। এর ভৌগলিক অবস্থান ২০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখা থেকে ৮০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা পর্যন্ত। এর গড় পানির গভীরতা ১২,২৪৭ ফুট। ভারত মহাসাগরের প্রান্তীয় দেশ ও দ্বীপপুঞ্জের নাম সমূহ হলো- ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, ইরিত্রিয়া, ঈশ্রায়েল, ওমান, কাতার, কুয়েত, কেনিয়া, সৌদি আরব, সোমালিল্যান্ড, সোমালিয়া, সেশেল ,সিঙ্গাপুর, সুদান, আমিরাত, শ্রীলংকা, মিশর, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মাদাগাস্কার, বাহরাইন, পূর্ব তিমুর, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, জরদান, কোকোস দ্বীপপুঞ্জ সহ প্রভৃতি।
আরও পড়ুনঃ রোবটিক্স কাকে বলে | রোবটিক্স এর ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহ
দক্ষিণ মহাসাগর
পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে যে বিপুল পরিমাণ জলরাশির অবস্থান সেটিই হলো দক্ষিণ মহাসাগর যা এন্টার্কটিকা মহাসাগর নামেও পরিচিত। আয়তনে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম এই মহাদেশটির জলরাশির অবস্থান দক্ষিণ অক্ষরেখার ৬০° বরাবর। আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা একে অন্য থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে মূলত এই মহাসাগরের সৃষ্টি হয়। তাই, প্রত্যেকটি মহাসাগর গুলোর মধ্যে দক্ষিণ মহাসাগর কে নবীনতম সাগর হিসেবে মনে করা হয়। এর সীমানার মধ্যে অবস্থিত সাগরগুলো হলো- লাজারেভ সাগর, মওসন সাগর, রিসার লার্সেন সাগর, স্কটিয়া সাগর, রোস সাগর, সমোভ সাগর, এবং মেডেল সাগর। আর এদের মধ্যে লাজারিভ সাগরটি প্রায় ৯,২৯,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।
উত্তর মহাসাগর
উত্তর মহাসাগর বা সুমেরু মহাসাগর উত্তর গোলার্ধের সুমেরু অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের ক্ষুদ্রতম এবং সর্বাপেক্ষা কম গভীর মহাসাগর। এটি পৃথিবীর পাঁচটি প্রধান মহাসাগর গুলোর মধ্যে অন্যতম যা আর্কটিক মহাসাগর হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত। এর বেশিরভাগই উত্তর গোলার্ধের মধ্যবর্তী আর্কটিক উত্তর মেরু অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। আর্কটিক মহাসাগর প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ইউরেশিয়া ও উত্তর আমেরিকা দ্বারা বেষ্টিত। এটি মূলত আংশিকভাবে সারা বছর ধরে সমুদ্রের বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। এর তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা ঋতু অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। এছাড়াও সমুদ্রের বরফের আবরণের গলন ও জমাট বাধার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। পাঁচটি প্রধান মহাসাগরের তুলনায় এই মহাসাগরের জলের লবণাক্ততা খুবই কম আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে বাষ্পীভবনের নিম্নহার। বিভিন্ন বড় বড় ও ছোট নদী থেকে এসে মেশা মিষ্টি জলের প্রবাহ সেইসাথে পার্শ্ববর্তী উচ্চ লবণাক্ততা যুক্ত মহাসাগর গুলোর সঙ্গে সীমাবদ্ধ সংযোগ ও বহির্গমন স্রোত এ লবণাক্ত পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এর প্রধান বন্দর গুলো হলো- মুরমানসক, আরখানগেলস, ও পড়ুদেহোবে।
এই লেখাটি পড়ে আপনারা পাঁচটি মহাসাগর সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা লাভ করতে পারলেন। ধন্যবাদ সবাইকে।