মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে, আকারে-ইঙ্গিতের নির্বাক অথবা প্রাক ভাষা থেকে অন্তত একবার মৌখিক ভাষার জন্ম হয়। তবে বর্তমান মানব সভ্যতার কোথাও এখন সেই আদিম প্রাক ভাষার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তাইতো আজও অসংখ্য বিজ্ঞানীরা তাদের বিভিন্ন অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ভাষার উৎস খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ভাষার কথা যখনই উঠে আসে প্রায় সবার মনে প্রশ্ন জাগে, এই ভাষা কোথা থেকে এলো? এর ইতিহাসের শুরুটা কোথায়? আমাদের পূর্বপুরুষরা কবে প্রথম কথা বলতে শিখেছিল? এখন যে হাজার হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলে সেগুলো কি ঐ একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছিল নাকি আলাদা আলাদা কোনো মাধ্যম ছিল? পর্যালোচনা করার মাধ্যমে এসব ভাষার ইতিহাস থেকে কি তার উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব? কখনো কি জানতে পারবো এর আসল ইতিহাস? এমন হাজারো প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে থেকে মানুষ ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান করে চলেছে।
আরও পড়ুনঃ ২৫০+ উপদেশ মূলক কথা বাণী উক্তি
এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয় জটিল যত বিষয় আছে তার একটি হল এই ভাষা এবং এটি আমাদের মানুষকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টির কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে অর্থাৎ মানুষ বানিয়েছে আমাদের। আর এই বক্তব্য পেশ করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব বিবর্তন বিভাগের শিক্ষক ও বিজ্ঞানী রবার্ট ফোলি।
ভাষার ইতিহাস
ভাষা নিয়ে যত প্রশ্ন আছে, তার অন্যতম প্রধান অংশ হলো ভাষার উৎস যার ভাষাবৈজ্ঞানিক ইংরেজি নাম গ্লটোগণি ও গ্লসোগনি। ভাষার ইতিহাস নিয়ে এবং ভাষার সৃষ্টি নিয়ে অসংখ্য গল্প আমরা প্রায় সবাই ছোটকালে পড়েছি বা শুনেছি। বিশেষ করে ব্যাকরণ বইটাতে এই নিয়ে গল্প থাকতো। অবশ্য সেই গল্পটা সরাসরি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে নয় বরং বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি নিয়ে তৈরি করা। তবে আমরা এখানে ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হবো। কিন্তু ইতিহাস জানতে হলে অবশ্যই জানতে হবে এর সমস্ত বৃত্তান্ত তথ্য।
তো চলুন এবার জেনে নেই ভাষার সেই প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে।
ভাষার উৎস বা উৎপত্তি
বিশ্বের অনেক ধর্মেই ভাষার উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইহুদি, খ্রিষ্টান আর ইসলাম ধর্মের ধারায় বলা হয় সৃষ্টিকর্তা যখন প্রথম মানুষ আদমকে অর্থাৎ আদি পিতা কে বিশ্বের যাবতীয় প্রাণী জগতের উপর কর্তৃত্ব দেন এবং সেইসব প্রাণিজগতের প্রত্যেকটি পশুপাখির একটি করে নাম দেন তখনই আদমের ভাষা জ্ঞানের প্রথম বড় প্রয়োগ ঘটে।
আবার প্রাচীন ব্যাবিলনের এক গল্পে জানা যায়, মানুষ ভেবেছিল একটা টাওয়ার বানাবে। আর টাওয়ারের শীর্ষ উচ্চ চূড়া ছুঁয়ে ফেলবে আকাশের গা ঘেঁষে এবং পৌঁছে যাবে স্রষ্টার কাছে। তাদের ধারণা ছিল নীল আকাশের ওপারে স্রষ্টা বসে আছেন। আর তিনি সেখানেই বাস করেন। তাই সকলে প্রচেষ্টা করে যদি একটা টাওয়ার বানানো যায় তাহলে খুব সহজেই সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে যাওয়া যাবে সেই সাথে সামনাসামনি কথা বলা যাবে। তারা অনেক পরিশ্রম করে সেই টাওয়ার নির্মাণ করতে থাকে। কাজ যখন অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছায় তখন স্রষ্টা ভাবলেন, এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। কতদিন চলবে এসব! তাই, একদিন লোকজন যখন টাওয়ার নির্মাণের কাজ করার জন্য ইট পাথর আনতে গেল তারপর ফিরে এসে দেখল, কেউ আর কারোর কথা বুঝতে পারছে না। একেকজনের ভাষা একেক রকম হয়ে গেছে।
তাহলে এই ভাষা যদি আলাদা হয়ে যায় তাহলে মানুষ কীভাবে একে অপরের ভাব প্রকাশ কিভাবে বুঝবে? আর টাওয়ারের কাজ সম্পূর্ণ হবেই বা কীভাবে? এই গল্পের হাত ধরে এটা প্রকাশ পেয়েছে যে, স্রষ্টা মানুষদের ভাষার জ্ঞান দেওয়ার পর একাধিক ভাষার প্রচলন করবেন বলে এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
তবে এই গল্পের অনেক ফাঁকফোকর আছে। চাইলেই আমরা যে কেউ এই গল্পটা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে পারি, অনেক তর্ক বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আসলে তো সেসব প্রশ্ন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এই বিষয়টা কে খুব ভালোভাবে তলিয়ে দেখা। আর বোঝার চেষ্টা করা, আসলে এই গল্পে কী আছে, কী হয়েছিল, কী বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আর এটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আমাদের সেই প্রাচীন ইতিহাসে। জল্পনা-কল্পনায় ঘেরা সেই পুরনো কথায়।
আরও পড়ুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং কি | SALES AND MARKETING
তবে তার আগে ভাষার উৎপত্তি সঠিক সময়ে যদি আমরা সুনিশ্চিত হতে চাই তাহলে জানতে তো হবে বিজ্ঞানীদের কিছু তলিয়ে দেখা পদক্ষেপ। কারণ, গবেষণা করে দেখা গেছে ৮০ বছর আগে আফ্রিকার কিছু জঙ্গলে বাস করত এপ জাতীয় কিছু প্রাণী। আর এদের মধ্যে শিম্পাঞ্জি ও মানুষদের পূর্বপুরুষ ছিল। তারা সম্ভবত বর্তমানে গরিলাদের মতো দেখতে ছিল। জানা যায়, এরা বসবাস করতো গাছে আর মাটিতে চার পায়ে হেঁটে চলাচল করতো, ভিন্ন ডাকের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতো। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষ মানুষ দের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। আর এর পরেই নাকি ভাষার বিস্তার ঘটতে থাকে।
পরবর্তীতে বেশ কিছু বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলার পরে ১৯৬০ এর দশকে নোম চমস্কির প্রবর্তিত ধারণাগুলো ব্যাকরণের তত্ত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর এর হাত ধরে অন্যরকম একটা প্রভাব পরে ভাষার উপরে। পরে ভাষাবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় একটি প্রশ্ন হয়ে উঠে আসে, মস্তিষ্কে অন্তর্নিহিত যে ক্ষমতাবলে মানুষ তার জীবনের প্রথম বছরগুলি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দক্ষভাবে কোনো ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে সেই জৈবিক ক্ষমতার প্রকৃতি কী? এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষার উৎসের গবেষণা বিবর্তনবাদের জীব বিজ্ঞানের একটি অংশ বলেই মনে করা হয়।
আর ধারণা করা হয় ভাসায় যে ব্যাকরণের উৎস তা মানুষের অন্তর্নিহিত ভাষার ক্ষমতা। কিন্তু এই ক্ষমতাটা উদ্ভব ও বিকাশ ঘটলো কীভাবে? তবে এই নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ইদানিং বেশ কিছু ভাষা বিজ্ঞানী সহ স্টিভেন পিংকার এই নিরুদ্বেগ কাটিয়ে ভাষার ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী হয়েছেন আর চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা। ভাষার উৎপত্তি ও উৎস এই বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করা হলেও একদম সঠিক সময়কাল এখন পর্যন্ত ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে সুস্পষ্ট নয়।
জীবাশ্ম থেকে প্রমাণ ও জিন বিজ্ঞানের ভূমিকা
পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়, ভাষার কবে উৎপত্তি ঘটেছিল অর্থাৎ আমরা ঠিক কবে ভাষা ব্যবহার করতে শিখেছিলাম অর্থাৎ কথা বলতে শুরু করেছিলাম।
অধ্যাপক ফোলি বলেছেন, কথা হচ্ছে এক ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া। আর এটা নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমেই আমরা শব্দ তৈরি করে থাকি। আমাদের বক্ষ এবং উদর এর মাঝখানে যে ঝিল্লির পর্দা সেটি অন্যদের থেকে আলাদা।
কিন্তু আমাদের আশেপাশে থাকা যেসব প্রাণী রয়েছে তাদের ঝিল্লির তুলনায় আমাদের ঝিল্লিতে নার্ভের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। আর এসব নার্ভের অর্থ আমাদের স্পাইনাল কর্ড এসব প্রাণির স্পাইনাল কর্ডের চেয়ে মোটা এবং আমাদের ভার্টিব্রাল কলাম একটু বেশি প্রশস্ত।
কিন্তু আজ থেকে ১০ লাখ বছর আগের দিকে ফিরে গেলে হোমোসেপিয়েন্স এর দিকে তাকালে বোঝা যাবে, যারা মানবজাতির প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ তাদের দেহে এরকম টা ছিল না। তাই, এই থেকে ধারণা করা হয় মানুষ কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিল।
আরও পড়ুনঃ সেলস অফিসারের কাজ কি এবং কি কি দক্ষতা থাকতে হবে
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জীবাশ্মের রেকর্ড এর বাইরে ও জিন বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে ভাষার বয়স জানা সম্ভব। এফওএক্সপিটু নামের এক ধরনের জিন রয়েছে যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরেই আছে। কিন্তু মানব শরীরে যেটি রয়েছে সেটা এর স্থানান্তরিত রূপ। তাই, জিনের এই রূপান্তর গবেষণা করে বোঝা যায়, কেন মানুষ কথা বলতে পারে আর অন্যরা পারে না। মূলত কথা বলা ও ভাষার বিকাশ এর ওপর এই জিন এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অধ্যাপক ট্রলার ম্যান বলেছেন, কথার সাথে ভাষার তফাৎ আছে। তবে কী কারণে কথা একসময় ভাষা হয়ে ওঠে সেটা জিনগত তথ্যপ্রমাণ থেকে নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু জীববিজ্ঞানের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হতে পারে, মানুষের ভাষার দক্ষতা উন্নতির ছাপ তার আশেপাশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, তার হাতিয়ার এর শিল্পে ইত্যাদিতে পড়ার কথা। সত্যি বলতে ৪০ হাজার বছর আগে মানুষের হাতিয়ার ও সরঞ্জাম এর বৈশিষ্ট্যে এক ধরনের ব্যাপক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। আর সেই সময় এর তারিখ গুলো আধুনিক ভাষা উদ্ভবের তারিখ হিসেবে অনেক দেরির তারিখ বলেই গণ্য করা হয়।
এছাড়াও এর ইতিহাস জানতে গিয়ে উঠে আসে, মানবজাতির শুরুতে কথা বলা শুরু হয়েছিল একে অপরকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণ করতে গিয়ে। কারণ পূর্বপুরুষরা বড় বড় শিকারি প্রাণিদের হাতে নিহত হতো। যেহেতু তারা মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করতো, সেহেতু এর পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক টলার ম্যান মন্তব্য করেন, “হায়নাদের হাতে নিহত পশুদের মরা দেহ থেকে মাংস খেতে হলে সাথে আরও কিছু মানুষের প্রয়োজন হতো। কারণ, এটা একটা বিপদজনক কাজ ছিল। আর তাই কোনো দল ছাড়া এই কাজ করা সম্ভব ছিল না। এরজন্যই সঙ্গে থাকা মানুষদের সাথে মনের কথা বিনিময় করার জন্য একটা ভাষার দরকার তো হতো।”
আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, একসাথে মিলে কাজ করার ক্ষমতা থেকেও ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা তৈরি হয়েছিল, উৎপত্তি হয়েছিল ভাষার। আর এক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে হরহামেশাই অনেকের মনে একটি প্রশ্ন জাগে প্রথম শব্দ কী ছিল? ভাষার ইতিহাস যেহেতু অনেক বিস্তৃত তাই এর সঠিক কোনো তথ্য আজও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা দেয় নি। অনেকে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধারণা করতে পেরেছে অনেক কিছু। আর এভাবেই শব্দ নিয়ে যখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন তখন তাদের সামনে ধরা দেয় বেশ কিছু অজানা তথ্য।
আরও পড়ুনঃ রোবটিক্স কাকে বলে | রোবটিক্স এর ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহ
কিন্তু এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলে প্রফেসর ফোলি বলেন, সত্যি বলতে এর সৎ উত্তর হবে আমাদের আসলে কোনো ধারণাই নেই যে প্রথম শব্দ কী ছিল।
মানব ইতিহাসের শুরুর দিকে যে শব্দগুলো চালু ছিল বলে ধারণা করা হয়, সেগুলো আসলে অনুমান নির্ভর এবং এটা যে সঠিক এর কোনো ভিত্তি নেই। সেই শব্দগুলো হলো- ঈগল, চিতা অথবা দেখো।
তবে এতকিছুর পরেও বেশকিছু ইউরোপীয় দার্শনিক মন্তব্য করেন ভাষার উৎস নির্ণয় করা, ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য বের করে নিয়ে আসা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। ভাষা যে মানুষের লিখিত ইতিহাস এর চেয়ে বহু প্রাচীন এ ব্যাপারটি তারা তেমন গুরুত্ব দেন নি। তাদের মতে, ভাষাহীন মানুষ কিভাবে বসবাস করত তা মনের পর্দায় গভীরভাবে কল্পনা করে যৌক্তিকভাবে ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু তাদের এই ধারণা পরবর্তীতে সঠিক বলে বিবেচিত হয় নি।