পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাসঃ সূর্য থেকে দূরত্ব অনুযায়ী অবস্থানে তৃতীয়, সেইসাথে সর্বাপেক্ষা অধিক ঘনত্ব যুক্ত এবং সৌরজগতের মোট আটটি গ্রহের মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা কোন গ্রহের কথা বলছি। হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন, আপনি মনেমনে যে গ্রহের কথা ভাবছেন তাকে ঘিরেই আজকের এই লেখাটি।

পৃথিবীর ইতিহাস বলতে পৃথিবী নামক গ্রহটির উৎপত্তি থেকে আরম্ভ করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমগ্র সময়কালকেই বোঝানো হয়।

এটি হলো একমাত্র মহাজাগতিক স্থান যেখানে রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। কিন্তু এত বছরের অনেক গবেষণার পরেও যখন মানুষের মুখে প্রশ্ন হয়ে উঠে আসে- পৃথিবীর সৃষ্টি কবে? তখন অনেকের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, বিজ্ঞানীরা এর সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন পর্যন্ত দিতে পারে নি। তবে জানা গেছে, এক বিলিয়ন বছরের মধ্যেই পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীতে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল ও অন্যান্য অজৈবিক অবস্থা গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। যারফলে একদিকে যেমন বায়ুজীবী জীবজগতের বংশ বৃদ্ধি ঘটেছে ঠিক একইভাবে অন্যদিকে ওজোন স্তর গঠিত হয়েছে। 

পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস

পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস

তবে বারবার যখন পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে, তখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে একটি ধারণায় উপনীত হয়েছেন। তাই তাদের মতে সৌর জগৎ সৃষ্টির মোটামুটি ১০০ মিলিয়ন বছর পর অর্থাৎ ১ বিলিয়ন বছর পর একগুচ্ছ সংঘর্ষের ফল স্বরূপ আজকের এই পৃথিবী। 

আরও পড়ুনঃ ভাষার ইতিহাস | ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

তারা গবেষণা করে আরো জেনেছে যে, আজ থেকে ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর পূর্বে এই গ্রহটি তার আকৃতি পায় অর্থাৎ একটি কেন্দ্র আর একটি বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি হয় পৃথিবীতে। 

Google News

এর পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমিক কয়েকটি ধারার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় আজকের বাসোপযোগী গ্রহ পৃথিবীর। এবার চলুন এক এক করে জেনে নেই সেই সকল ধারার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। যেগুলো জানলে আপনারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন আজকের এই গ্রহের সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিল। 

১. পৃথিবী-চাঁদ ঘর্ষণ

এই নীল গ্রহের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ। তাই চাঁদের গঠন সম্পর্কিত সকল অজানা রহস্য উদঘাটনের জন্য গবেষণা চালিয়েছে বিজ্ঞানীরা। তবে পৃথিবীর সৃষ্টির এত বছর পরেও এটি নিয়ে এখনও ব্যাপক গবেষণা চলছে সেইসাথে একাধিক ভিন্ন অভিমতও রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। অন্যান্য প্রস্তাবিত তত্ত্বেরর মধ্যে রয়েছে ফিশন, গঠন একত্রীকরণ, গ্রহাণু তত্ত্ব এবং মহাকর্ষীয় সংঘর্ষ তত্ত্ব। 

তবে যাই হোক, এ পর্যন্ত গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এটা জানতে পেরেছে, পৃথিবীর শুরুর দিকে, থিয়া নামের মোটামুটি মঙ্গলের আকৃতির একটা গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ হয় পৃথিবীর। আর এই সংঘর্ষের ফলে এটি মোটামুটি আস্তই থাকে। কিন্তু বায়ুমণ্ডল উবে যায় আর ধ্বংস হয়ে যায় সেই গ্রহাণুটি। আর সেই থিয়া গ্রহাণুর ধ্বংসাবশেষ থেকেই তৈরি হয় চাঁদ। 

২. গলিত লাভার সমুদ্র

আমরা প্রথম পয়েন্টে জেনেছি যে, খিয়া নামক একটি গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পৃথিবীর। আর মূলত এই গ্রহের সাথে সংঘর্ষের ফলে চাঁদের সৃষ্টি হয় সেই সাথে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে পৃথিবী। টগবগ করে ফুটতে থাকা গলিত লাভার সমুদ্র তখন এর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুক্র গ্রহের অবস্থা এখন যেমন তখন পৃথিবীর অবস্থা ছিল ঠিক সেরকম। কিন্তু সময় বিবর্তনের সাথেসাথে উত্তপ্ত পৃথিবী ধীরেধীরে ঠাণ্ডা হতে থাকে। আর লাভা জমাট বেঁধে তৈরি হয়ে যায় পাথর। আর জল জমে সৃষ্টি হয় পৃথিবীর প্রথম মহাসাগর। শুধু তাই নয়, গবেষণা করে আরও জানা যায়, তখনই সৃষ্টি হয় প্রাচীনতম খনিজ, জিরকন। যাদের বয়স মোটামুটি ৪.৪ বিলিয়ন বছর।

৩. প্রথম মহাদেশ ও মহাসাগর

আজকের এই পৃথিবীতে বিভিন্ন মহাদেশ বসে আছে অতিকায় সব টেকটনিক প্লেটের উপরে। জানা যায়, আদিম টেকটোনিক প্লেটগুলোর ছিল আকারে অনেক ছোট। এদের মাঝে অনেক সময় প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্যর মতো দামি ধাতু পাওয়া যেত। অর্থাৎ পৃথিবীতে স্বর্ণের উৎপত্তি ঘটেছিল সেখান থেকেই। আর তখনই তৈরি হয়েছিল প্রথম মহাদেশ। বৈজ্ঞানিকদের হিসাব মতে সেই সময়কাল ছিল আজ থেকে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। 

৪. প্রাণের প্রথম আগমন

পৃথিবীতে মূলত সালোকসংশ্লেষণ থেকে আসে প্রথম অক্সিজেন। মোটামুটি হিসেব মতে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পাথরের উপরে জন্মানো সায়ানোব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ নীলচে সবুজ শ্যাওলা থেকে প্রথম আগমন ঘটে ছিল অক্সিজেনের।

আরও পড়ুনঃ ২৫০+ উপদেশ মূলক কথা বাণী উক্তি

কিন্তু গবেষণা করে দেখা গেছে এটা ভালো কিছু করতে সাহায্য করে নি। এই অক্সিজেন এর উপস্থিতির কারণে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া মরে যেত যারা সেই অক্সিজেনের উপস্থিতি সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু পরবর্তীতে ২.৪ মিলিয়ন বছর আগে অক্সিজেন অনেক বেশি বেড়ে যায়, যা প্রানীর বেঁচে থাকার জন্য বেশ উপযোগী।

৫. নীরুপদ্রব এক বিলিয়ন বছর

এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে পৃথিবীতে প্রথম মহাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরবর্তী এক বিলিয়ন বছরে এর তেমন কিছু পরিবর্তন ঘটে নি। দীর্ঘদিন কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই একঘেঁয়ে একটা সময় কেটে গেছে। বলতে পারেন পৃথিবীতে সৃষ্টি হওয়া প্রথম সেই মহাদেশগুলো আটকে ছিল একটা ট্রাফিক জ্যামে। যে কারণে সামনেও এগোতে পারেনি, আবার পিছিয়ে যাওয়ারও রাস্তা ছিল না। অর্থাৎ প্রাণের তেমন কোনো উন্নতি ঘটে নি সেসময়।

৬. মহা মহাদেশ

এই সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল মহা মহাদেশের। গবেষণা করে দেখা গেছে মহা-মহাদেশের মাঝে একটি হলো- প্যানগায়া। এটা বিভক্ত হয়ে তৈরি হয় অনেকগুলো মহাদেশ।  

৭. আতঙ্কিত শীতকাল

হঠাৎ করেই পৃথিবীতে ৭৫০ মিলিয়ন বছর আগে একটা বড় মহাদেশ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে বের হয়ে আসে। আর তখন পৃথিবী পরিণত হয় ঠান্ডা বরফ জমা কুপে। সেই সময় পুরো পৃথিবীটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে একটা বিশাল বরফ খন্ডের গলায় রূপান্তরিত হয়। জানা যায়, সেই সময়ে হিমবাহ দিয়ে ঢাকা ছিল পুরো ভূপৃষ্ঠ, এমনকি বিষুবীয় অঞ্চলেও ছিল হিমবাহ।

৮. প্রাণের বিস্ফোরণ

৩.৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে যখন সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেনের উদ্ভব ঘটে, তখন প্রাণের নিঃশ্বাস প্রথম ছড়িয়ে পড়ে এই গ্রহের বুকে। কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় সবকিছু স্থগিত থাকার পরে ৬৫০ মিলিয়ন বছর আগে হঠাৎ করেই আবারও বেড়ে যেতে থাকে অক্সিজেন। আর সাথেসাথে উদ্ভব ঘটে বিভিন্ন প্রাণির। শুরুতে এককোষী প্রাণী পরবর্তীতে বহুকোষী প্রাণির উদ্ভব ঘটে থাকে। আর এর পরবর্তী সময় সীমার মাঝেই শিকার এবং শিকারীরও আগমন ঘটে।

আরও পড়ুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং কি | SALES AND MARKETING

৯. প্রাণের বিলুপ্তি

দীর্ঘ সময় পরে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে ২৫২ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান পিরিয়ডে। কারণ, সেসময় মাত্র ৬০ হাজার বছরের মাঝে প্রায় ৯০% জীবের বিলুপ্তি ঘটেছিল। জানা যায় প্রায় ৮৫ শতাংশ জীব সহ ডাইনোসর প্রানীর বিলুপ্তি ঘটেছিল আজ থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে। যে পিরিয়ডের নাম ছিল ক্রেটেশাস। পরবর্তীতে শেষের দিকে অর্থাৎ ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে বড়সড় একটা তুষার যুগ এর কারণে বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৭৫% প্রাণের।

১০. আধুনিক পৃথিবী

কালানুক্রমিক এই পর্যায়গুলো পাড়ি জমানোর পরবর্তীতে পৃথিবী আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছায়। আর লক্ষ কোটি প্রাণের সমাগম ঘটে। তবে জানা গেছে, এত বছর পেরিয়া আসার যাত্রাপথে পাঁচটি বড় বরফ যুগ পাড়ি দিতে হয়েছে। জানলে অবাক হবেন, আমরা বর্তমানে যে যুগে রয়েছে এটিও একটি বরফ যুগ। আপনি কি জানেন আমরা বরফ যুগের মাঝামাঝি সময়ে বাস করছি? হয়তো জানেন না। তবে পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে আজ থেকে প্রায় ১১,৫০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল একটা বরফ যুগ আর আমরা তারই মাঝামাঝি সময়ে অবস্থান করছি। 

তো বন্ধুরা আমাদের আজকের লেখাটি এপর্যন্তই। আশাকরি এই লেখাটি থেকে নতুন কিছু জানতে পেরেছেন। যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।